বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে শিশু কক্ষ: শ্রম আইন ও কমপ্লায়েন্সের একটি সম্পূর্ণ গাইড

 

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। তাদের সন্তানদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখার জন্য শিশু কক্ষ একটি অপরিহার্য উদ্যোগ। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ৯৪ অনুযায়ী, যেসব কারখানায় ৪০ বা ততোধিক মহিলা শ্রমিক নিয়োজিত, তাদের ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য উপযুক্ত শিশু কক্ষ বা শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা বাধ্যতামূলক। এই ব্লগে আমরা শিশু কক্ষের আইনি কাঠামো, বিধিমালা, পরিচর্যাকারীর দায়িত্ব, এবং আবেদন ও অনুমোদন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। এই তথ্যগুলো এইচআর ও কমপ্লায়েন্স পেশাজীবীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 ১. বাংলাদেশ শ্রম আইনে শিশু কক্ষ (ধারা ৯৪)

 বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ৯৪ শিশু কক্ষের জন্য নিম্নলিখিত বিধান প্রদান করে:

1. বাধ্যতামূলক শিশু কক্ষ: যেসব প্রতিষ্ঠানে ৪০ বা ততোধিক মহিলা শ্রমিক নিয়োজিত, তাদের ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য এক বা একাধিক উপযুক্ত কক্ষ স্থাপন করতে হবে।
2. পরিবেশ: কক্ষটিতে পর্যাপ্ত আলো, বায়ুচলাচল, এবং স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ থাকতে হবে। এটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং প্রশিক্ষিত মহিলা পরিচর্যাকারীর তত্ত্বাবধানে থাকবে।
3. অবস্থান: শিশু কক্ষটি শ্রমিক মায়েদের জন্য সহজগম্য হতে হবে এবং ধোঁয়া, ধুলাবালি, গন্ধ, বা অতিরিক্ত শব্দময় এলাকার কাছাকাছি হবে না।
4. নির্মাণ: কক্ষটি মজবুত, তাপ-প্রতিরোধী, এবং পানিরোধক হতে হবে। ছাদের উচ্চতা কমপক্ষে ৩৬০ সেন্টিমিটার এবং প্রতি শিশুর জন্য মেঝের স্থান কমপক্ষে ৬০০ বর্গ সেন্টিমিটার হতে হবে।
5. সুবিধা: প্রতিটি শিশুর জন্য বিছানা, খাট বা দোলনা, মায়েদের জন্য চেয়ার, এবং বয়স্ক শিশুদের জন্য খেলনা সরবরাহ করতে হবে।
6. খেলার মাঠ: তুলনামূলকভাবে বয়স্ক শিশুদের জন্য ঘেরা, ছায়াযুক্ত খেলার মাঠ থাকতে হবে। তবে, জায়গার অভাবে প্রধান পরিদর্শক এই শর্ত থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন।

২. বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালায় শিশু কক্ষ (বিধি ৯৪) 

বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ শিশু কক্ষের জন্য নিম্নলিখিত বিধান প্রদান করে:

1. অনুমোদন: শিশু কক্ষের নকশা, মান, এবং অবস্থান মহাপরিদর্শক বা তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্ত পরিদর্শক কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।
2. দুগ্ধদানের স্থান: মায়েদের জন্য গোপনীয়তা ও শালীনতা বজায় রেখে দুগ্ধপানের জন্য পৃথক কক্ষ বা পর্দাঘেরা স্থান থাকতে হবে।
3. মেঝে ও দেয়াল: মেঝে এবং দেয়ালের ১.২২ মিটার পর্যন্ত অংশ মসৃণ ও অভেদ্য হতে হবে।
4. খাবার সরবরাহ: প্রতি শিশুর জন্য দৈনিক ০.২৫ লিটার দুধ এবং পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করতে হবে।
5. পরিচ্ছন্নতা: শিশু কক্ষের কর্মীদের জন্য পরিষ্কার পোশাক সরবরাহ করতে হবে।
6. নিয়োগে অগ্রাধিকার: শিশু কক্ষে কর্মী নিয়োগে মহিলাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৩. কার্যকরী পরিষদ

 শিশু যত্ন কেন্দ্রের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে একটি কার্যকরী পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের দায়িত্ব হলো শিশু কক্ষের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। পরিষদের সদস্যরা হলেন:

• সভাপতি
• সহ-সভাপতি
• সাংগঠনিক সম্পাদক
• সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক
• সদস্য: মেডিকেল অফিসার, নার্স, শ্রমিক প্রতিনিধি
• সদস্য: সেকশন/শাখা প্রধান

এই পরিষদ নিশ্চিত করে যে শিশু কক্ষের সুবিধা আইন মেনে পরিচালিত হচ্ছে এবং শ্রমিকদের সন্তানদের যথাযথ যত্ন দেওয়া হচ্ছে।

 ৪. শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র নীতিমালা

শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে নিম্নলিখিত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়:

1. শিশুদের যত্ন: ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রশিক্ষিত পরিচর্যাকারীর তত্ত্বাবধানে মাতৃস্নেহে লালন করা হবে।
2. পরিচ্ছন্নতা: শিশুদের বেবি সোপ দিয়ে গোসল করানো, কাপড় পরিবর্তন, এবং মলমূত্র ত্যাগের পর হাত ধোয়ানো হবে।
3. খেলনা ও শিক্ষা: শিশুদের জন্য উপযুক্ত খেলনা এবং বর্ণমালার সাথে পরিচিতির ব্যবস্থা থাকবে।
4. মায়েদের প্রবেশাধিকার: মায়েরা যেকোনো সময় সন্তানদের দেখতে বা দুগ্ধপান করাতে পারবেন।
5. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: বেডশিট, বালিশের কভার, এবং কক্ষ নিয়মিত পরিষ্কার করা হবে।
6. পানি ও খাবার: শিশুদের জন্য ফিল্টার করা পানি এবং পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা হবে।
7. তদারকি: ওয়েলফেয়ার অফিসার এবং প্রশাসন বিভাগ নিয়মিত তদারকি করবে।

শিশু কক্ষে প্রয়োজনীয় ফ্লোর বেড, বিছানা, খেলনা, বই, এবং পানির ফিল্টারসহ সকল সুবিধা থাকবে। মায়েদের জন্য দুগ্ধদানের সুবিধার জন্য পর্দাঘেরা স্থান এবং বসার ব্যবস্থা থাকবে।

 

 ৫. শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তির আবেদন পত্রের নমুনা

 শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তির আবেদন পত্র
(শুধুমাত্র ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য প্রযোজ্য)

 

 তারিখ: [তারিখ লিখুন]
বরাবর,
ব্যবস্থাপক (কমপ্লায়েন্স)
[কারখানার নাম ও ঠিকানা]
 

বিষয়: শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তির আবেদন পত্র
 

জনাব,

আমি [আবেদনকারীর নাম], পদবী: [পদবী], কার্ড নং: [কার্ড নম্বর], বিভাগ: [বিভাগ], আপনার কারখানায় বর্তমানে কর্মরত আছি। আমার শিশুর সঠিক পরিচর্যা নিশ্চিত করার জন্য [তারিখ] হতে কারখানার শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে আমার শিশুকে রাখতে ইচ্ছুক।

শিশুর বিবরণ:
•    শিশুর নাম: [নাম]
•    জন্ম তারিখ: [তারিখ]
•    বয়স: [বছর, মাস, দিন]
•    পিতার নাম: [নাম]
•    শারীরিক অক্ষমতা (যদি থাকে): [বিবরণ/নেই]
•    বর্তমান ঠিকানা: [ঠিকানা]
•    স্থায়ী ঠিকানা: [ঠিকানা]

আমি কোম্পানির শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র সংক্রান্ত সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলতে বাধ্য থাকব। আমার শিশুকে কেন্দ্রে রাখার অনুমতি প্রদানের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

 

আবেদনকারীর স্বাক্ষর: [স্বাক্ষর]
নাম: [নাম]
কার্ড নং: [নম্বর]
পদবী: [পদবী]
সেকশন: [সেকশন]

 

কর্মকর্তার স্বাক্ষর: [কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও তারিখ]

৬. শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখার অনুমোদন পত্রের নমুনা

শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখার অনুমোদন পত্র
(শুধুমাত্র ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য প্রযোজ্য)

 

তারিখ: [তারিখ]
আবেদনকারীর নাম: [নাম]
কার্ড নং: [নম্বর]
পদবী: [পদবী]
বিভাগ/সেকশন: [বিভাগ]

আপনার [তারিখ]-এর আবেদনপত্রের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, আপনার শিশু [শিশুর নাম]-কে [তারিখ] হতে কারখানার শিশু পরিচর্যা কক্ষে রাখার অনুমতি দেওয়া হলো।
 

 

ধন্যবাদান্তে,
[কর্মকর্তার স্বাক্ষর]
 

 

প্রাপ্তি স্বীকার: [আবেদনকারীর স্বাক্ষর]
 

 

 

অনুলিপি:
1.    অফিস কপি
2.    ব্যক্তিগত ফাইল

৭. শিশু পরিচর্যাকারীনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

পদবী: শিশু পরিচর্যাকারী
প্রধান দায়িত্ব: শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের ব্যবহার ও শিশুদের যথাযথ লালন-পালন।
প্রধান উদ্দেশ্য: মা শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশু যত্ন নিশ্চিত করা।
রিপোর্টিং: ব্যবস্থাপক (কমপ্লায়েন্স এন্ড অ্যাডমিন), ওয়েলফেয়ার অফিসার, বা এক্সিকিউটিভ।
 

দায়িত্বসমূহ:

1. শিশুদের অভিভাবকের কাছ থেকে গ্রহণ ও হস্তান্তর করা এবং রেজিস্টারে তথ্য আপডেট রাখা।
2. শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর রাখা।
3. শিশুদের অসুস্থতার ক্ষেত্রে ডাক্তার, নার্স, বা ওয়েলফেয়ার অফিসারকে অবহিত করা।
4. কক্ষে পর্যাপ্ত আলো ও বায়ুচলাচল নিশ্চিত করা।
5. শিশুদের জন্য নির্ধারিত খাবার সরবরাহ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
6. শিশুদের পোশাক, তোয়ালে, এবং খেলনা জীবাণুমুক্ত রাখা।
7. অননুমোদিত ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ করা।
8. দিন শেষে কক্ষ পরিষ্কার করে বন্ধ করা।

 

৮. শিশু কক্ষের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী

 শিশু কক্ষের সঠিক পরিচালনা ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে হবে:

1. কক্ষে পর্যাপ্ত আলো ও বায়ুচলাচল নিশ্চিত করা।
2. কক্ষ সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
3. পরিচর্যাকারীদের পরিষ্কার পোশাক পরিধান করা।
4. শিশুদের সব সময় পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখা।
5. খাবারের পাত্র সর্বদা পরিষ্কার রাখা।
6. ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত শিশুদের তাৎক্ষণিক আলাদা করা।
7. কারখানার ডাক্তার নিয়মিত শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন।
8. শিশুদের জন্য নিরাপদ খেলনা সরবরাহ করা।
9. কোনো শিশু যেন একা বাইরে না যায়, সর্বদা সতর্ক থাকা।
10. শিশুদের সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলা বা মারধর করা নিষিদ্ধ।

 প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

 ১. কোন কারখানায় শিশু কক্ষ বাধ্যতামূলক?
৪০ বা ততোধিক মহিলা শ্রমিক নিয়োজিত কারখানায় শিশু কক্ষ স্থাপন বাধ্যতামূলক।
২. শিশু কক্ষে কারা যত্ন নেয়?
প্রশিক্ষিত মহিলা পরিচর্যাকারীরা শিশুদের যত্ন নেন, এবং তাদের নিয়োগে মহিলাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
৩. শিশু কক্ষের সুবিধাগুলো কী কী?
পর্যাপ্ত আলো, বায়ুচলাচল, বিছানা, খেলনা, পুষ্টিকর খাবার, এবং দুগ্ধদানের জন্য পৃথক স্থান।
৪. শিশু কক্ষে ভর্তির জন্য কী করতে হবে?
এইচআর ও কমপ্লায়েন্স বিভাগ থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করে পূরণ করতে হবে।
৫. শিশু কক্ষে কোন বয়সের শিশুদের রাখা যায়?
৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের রাখা যায়।

 

 

শিশু কক্ষ বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা, যা তাদের সন্তানদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখতে সহায়তা করে। শ্রম আইনের ধারা ৯৪ এবং বিধিমালা ৯৪ অনুসরণ করে শিশু কক্ষ পরিচালনা করা কমপ্লায়েন্সের একটি মূল অংশ। এইচআর ও কমপ্লায়েন্স পেশাজীবীদের এই বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশু কক্ষ শুধু শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করবে না, বরং কারখানার সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা ও সুনামও বাড়াবে।

 

 মূল উদ্ধৃতি:
•    বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬, ধারা ৯৪
•    বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫, বিধি ৯৪
•    শিল্প কারখানার কমপ্লায়েন্স নির্দেশিকা

#ChildCareCenter #LaborLaw #BangladeshRMG #SocialCompliance #GarmentIndustry