চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ (Contractual-Employment): বাংলাদেশের শ্রম আইন কী বলে? আপনার যা জানা দরকার!
শুরু করার আগে: একটি বাস্তব ঘটনা
একটি অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী রফিকুল ইসলাম গত মাসে চাকরি হারিয়েছেন। কারণ? তিনি ছিলেন "চুক্তিভিত্তিক কর্মী"। প্রতিষ্ঠানটি কোনো কারণ ছাড়াই তাকে বিদায় দিয়েছে, কোনো প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি ছাড়াই। রফিকুলের মতো হাজারো কর্মী প্রতিদিন এই অবিচারের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো - এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আদৌ কি বৈধ?
চুক্তিভিত্তিক কর্মী বলতে আসলে কী বোঝায়?
আপনি যদি কর্পোরেট জগতে কাজ করেন, তাহলে "Contractual Employee" শব্দটি আপনার অজানা নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো আজকাল স্থায়ী নিয়োগের বদলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। কিন্তু কেন?
- প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিকোণ: কম দায়বদ্ধতা, সহজে কর্মী ছাঁটাইয়ের সুযোগ
- কর্মীর দৃষ্টিকোণ: অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সুযোগ-সুবিধা বঞ্চনা
শ্রম আইনের রূপরেখা: কী বলে আইন?
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ধারা-২৮ স্পষ্টভাবে বলেছে:
"কোনো কর্মীকে চুক্তিভিত্তিক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া যাবে, তবে শুধুমাত্র সেই কর্মী যদি পূর্বে একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকেন এবং অবসর গ্রহণের পর তাকে পুনরায় চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া যায়।"এখানে তিনটি মূল বিষয় রয়েছে:
- শুধুমাত্র সাবেক কর্মীকে চুক্তিতে নেওয়া যায়
- অবসর গ্রহণের পরই কেবল এই সুযোগ
- নতুন কর্মীদের জন্য এই পদ্ধতি প্রযোজ্য নয়
চুক্তি আইনের সাথে মিলিয়ে দেখা
চুক্তি আইন, ১৮৭২-এর ধারা-২৩ বলছে: "কোনো চুক্তি তখনই বৈধ হবে, যদি তা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ না হয়।"
এখানে একটি মজার বিষয় হলো:
- আপনি যদি শ্রম আইন লঙ্ঘন করে চুক্তি করেন
- তাহলে সেই চুক্তি চুক্তি আইনেও অবৈধ
নিয়োগপত্র বনাম চুক্তিপত্র: পার্থক্য কোথায়?
শ্রম আইনের ধারা-৫ বলছে প্রতিটি নিয়োগের জন্য নিয়োগপত্র বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান:
- নিয়োগপত্র না দিয়ে শুধু চুক্তিপত্র সই করায়
- কর্মীদের পরিচয়পত্র দেয় না
- কর্মঘণ্টা, ছুটি, মজুরির হার স্পষ্ট করে উল্লেখ করে না
এগুলো সবই শ্রম আইনের লঙ্ঘন।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বৈধ উপায়
যদি সত্যিই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতেই হয়, তাহলে নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:
১. প্রকল্পভিত্তিক চুক্তি
- নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য
- সুনির্দিষ্ট সময়সীমা সহ
- প্রকল্প শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চুক্তি সমাপ্তি
২. আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে
- Third-Party কোম্পানির মাধ্যমে নিয়োগ
- মূল প্রতিষ্ঠান নয়, আউটসোর্সিং কোম্পানি হবে নিয়োগদাতা
৩. বিশেষজ্ঞ পরামর্শ
- অভিজ্ঞ শ্রম আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া
- সকল ডকুমেন্ট সঠিকভাবে প্রস্তুত করা
চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের অধিকার
অনেকেই ভাবেন চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের কোনো অধিকার নেই। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তাদেরও রয়েছে:
- ন্যায্য মজুরির অধিকার
- নিরাপদ কর্মপরিবেশের অধিকার
- চুক্তি অনুযায়ী সকল সুবিধা পাওয়ার অধিকার
- অবৈধভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত না হওয়ার অধিকার
প্রতিষ্ঠানের জন্য সতর্কতা
যেসব প্রতিষ্ঠান চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছেন, তাদের জন্য কিছু সতর্কবার্তা:
- শ্রম আদালতে মামলা হতে পারেজরিমানা গুনতে হতে পারে
- প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে পারে
- দক্ষ কর্মী ধরে রাখা কঠিন হবে
কর্মীদের জন্য পরামর্শ
আপনি যদি চুক্তিভিত্তিক কর্মী হন, তাহলে:
- চুক্তিপত্র ভালো করে পড়ে নিন
- সকল কপি নিজের কাছে রাখুন
- নিয়মিত কাজের রেকর্ড রাখুন
- কোনো সমস্যা হলে শ্রম আদালতে যান
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন(FAQ)
১. চুক্তিভিত্তিক কর্মী কি প্রভিডেন্ট ফান্ড পাবেন?
হ্যাঁ, যদি প্রতিষ্ঠান EPF Act-এর আওতায় থাকে।
২. চুক্তি শেষ হওয়ার আগে বরখাস্ত করা যায়?
না, চুক্তির শর্তানুযায়ী নোটিস পিরিয়ড দিতে হবে।
৩. চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা কি ইউনিয়ন করতে পারবেন?
হ্যাঁ, বাংলাদেশের সংবিধান এই অধিকার নিশ্চিত করেছে।
৪. প্রকল্পভিত্তিক চুক্তি কি বৈধ?
হ্যাঁ, যদি সুনির্দিষ্ট সময় ও কাজের জন্য হয়।
5. চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কি সম্পূর্ণ অবৈধ?
না, শুধুমাত্র অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের জন্য বৈধ। নতুন কর্মীদের জন্য নয়।
শেষ কথায়
"Contractual Employment" শব্দটি বাংলাদেশের শ্রম আইনে সীমিতভাবে স্বীকৃত। শুধুমাত্র অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। নতুন কর্মীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া আইনত অবৈধ এবং এটি প্রতিষ্ঠান ও কর্মী উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ একটি জটিল বিষয়। এটি যেমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুবিধাজনক, তেমনি অপব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে। আমাদের উচিত শ্রম আইন মেনে চলা এবং সকল কর্মীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা।
------ একটি পরামর্শ-----:
"চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে চাইলে একজন শ্রম আইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এটি ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যা থেকে আপনাকে রক্ষা করবে।"