(বাংলাদেশে Occupational Health & Safety (OHS) কেন এত গুরুত্বপূর্ণ)
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার কর্মীরা। কিন্তু অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা নিরাপত্তাহীনতার কারণে এই সম্পদই ঝুঁকির মুখে পড়ে।
Occupational Health and Safety (OHS) এমন একটি ধারণা যা কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের শিল্পখাতে—বিশেষ করে RMG (Ready-Made Garments), Construction, Leather, এবং Manufacturing সেক্টরে—OHS এখন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা শুধু কর্মীর জীবন নয়, প্রতিষ্ঠানের সুনাম, উৎপাদনশীলতা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও সরাসরি প্রভাব ফেলে।
এই লেখায় আমরা জানব, OHS আসলে কী, কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ, এবং কীভাবে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূলনীতি বাস্তবায়ন করা যায়।
Occupational Health and Safety (OHS) কী?
Occupational Health and Safety (OHS) হলো এমন একটি পদ্ধতি ও নীতিমালার সমষ্টি যা কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, আঘাত, রোগ বা মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস করে।
এটি নিশ্চিত করে যে কর্মীরা নিরাপদ পরিবেশে, উপযুক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার করে, এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করছে।
OHS মূলত তিনটি দিককে কভার করে:
- Occupational Health: কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা।
- Occupational Safety: কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ।
- Work Environment: স্বাস্থ্যকর, পরিচ্ছন্ন ও ঝুঁকিমুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরি।
বাংলাদেশে OHS কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পখাতের অবদান ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করার ঝুঁকি।
বিশেষ করে RMG সেক্টরে, Tazreen Fashions Fire (2012) ও Rana Plaza Tragedy (2013) আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, OHS অবহেলা কতটা ভয়াবহ পরিণতি আনতে পারে।
নিচে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো, কেন বাংলাদেশে OHS অপরিহার্যঃ
- কর্মীদের জীবনরক্ষা: প্রতিদিন হাজারো শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক পদার্থ ও গরম পরিবেশে কাজ করে।
- আইনি বাধ্যবাধকতা: বাংলাদেশ শ্রম আইন (২০০৬, সংশোধিত ২০১৮) অনুসারে প্রতিটি নিয়োগকর্তার জন্য কর্মক্ষেত্র নিরাপদ রাখা বাধ্যতামূলক।
- ব্র্যান্ড ও ক্রেতার চাহিদা: আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে OHS মানদণ্ড মেনে চলা নিশ্চিত করে।
- উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: নিরাপদ কর্মক্ষেত্রে কর্মীরা বেশি আত্মবিশ্বাসী হয় এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
- দুর্ঘটনা ও ক্ষতি কমানো: প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দুর্ঘটনা, অনুপস্থিতি ও আর্থিক ক্ষতি কমে।
কর্মক্ষেত্রে OHS বাস্তবায়নের মূলনীতি
নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য কিছু মৌলিক নীতি অনুসরণ করতে হয়। নিচে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কার্যকর কয়েকটি মূলনীতি আলোচনা করা হলোঃ
১. ঝুঁকি মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণ (Risk Assessment & Control)
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করার আগে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা উচিত।
যেমন: বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ, মেশিনের গরম অংশ, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি।
HR ও Admin টিমের দায়িত্ব হবে—
- নিয়মিত Safety Audit করা,
- ঝুঁকির তালিকা তৈরি,
- এবং তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া (যেমন: গার্ড, বায়ুচলাচল ব্যবস্থা, PPE ইত্যাদি)।
২. প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি (Training & Awareness)
অনেক দুর্ঘটনা হয় শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে।
তাই কর্মীদের Safety Training দেওয়া জরুরি, যেমনঃ
অগ্নি নির্বাপন প্রশিক্ষণ (Fire Drill),
- PPE ব্যবহারের নিয়ম,
- Chemical Handling,
- Emergency Exit Plan।
প্রতিটি কর্মীকে জানতে হবে—দুর্ঘটনা ঘটলে কীভাবে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে।
৩. Personal Protective Equipment (PPE) সরবরাহ ও ব্যবহার
Safety Helmet, Gloves, Goggles, Ear Plug, Mask, Safety Shoe — এই জিনিসগুলো কর্মক্ষেত্রে জীবন বাঁচাতে পারে।
কিন্তু অনেক সময় এগুলো দেওয়া হলেও কর্মীরা ব্যবহার করে না, কারণ তারা গুরুত্ব বোঝে না।
তাই HR-এর কাজ হলো PPE ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া এবং নিয়মিত তা পরিদর্শন করা।
৪. স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা (Health Protection Measures)
শুধু দুর্ঘটনা নয়, কর্মীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বড় বিষয়।
যেমন:
- গরম পরিবেশে Heat Stroke,
- রাসায়নিক সংস্পর্শে ত্বক বা শ্বাসজনিত রোগ,
- দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করার কারণে মাংসপেশির সমস্যা।
এই সমস্যা প্রতিরোধে নিয়মিত Medical Check-up, First Aid Box, এবং Emergency Health Care Room থাকা জরুরি।
৫. অগ্নি নিরাপত্তা (Fire Safety)
বাংলাদেশের ফ্যাক্টরি দুর্ঘটনার মধ্যে আগুন লাগা অন্যতম।
তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে থাকা উচিতঃ
- পর্যাপ্ত Fire Extinguisher,
- Clearly Marked Emergency Exit,
- Smoke Detector,
- এবং নিয়মিত Fire Drill অনুশীলন।
BNBC (Bangladesh National Building Code) অনুযায়ী অগ্নি নিরাপত্তা এখন বাধ্যতামূলক।
৬. কর্মক্ষেত্রের মানসিক নিরাপত্তা (Psychological Safety)
শুধু শারীরিক নয়, কর্মক্ষেত্রে মানসিক নিরাপত্তাও জরুরি।
কর্মীদের মধ্যে ভয়, হয়রানি বা অপমানের সংস্কৃতি থাকলে তারা কাজের আগ্রহ হারায়।
HR-এর দায়িত্ব হলো এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে কর্মীরা ভয় ছাড়া মতামত দিতে পারে এবং আত্মসম্মান বজায় রেখে কাজ করতে পারে।
৭. আইনি মান বজায় রাখা (Legal Compliance)
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুসারে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিয়োগ এবং OHS নীতিমালা প্রণয়ন বাধ্যতামূলক।
এছাড়া ILO Convention 155 ও ISO 45001: Occupational Health and Safety Management System মানদণ্ড অনুসরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ।
OHS বাস্তবায়নে HR বিভাগের ভূমিকা
মানব সম্পদ বিভাগই হচ্ছে OHS বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দু। তাদের দায়িত্বের মধ্যে থাকে—
- কর্মীদের সচেতন করা,
- প্রশিক্ষণ আয়োজন,
- দুর্ঘটনার রেকর্ড সংরক্ষণ,
- এবং সেফটি নীতিমালা অনুসরণ মনিটর করা।
👉 HR যদি সঠিকভাবে OHS বাস্তবায়ন করে, তাহলে প্রতিষ্ঠান শুধু নিরাপদ হয় না, বরং আন্তর্জাতিকভাবে compliance-approved অবস্থান অর্জন করে।
বাংলাদেশে OHS বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
যদিও এখন অনেক প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—
- সচেতনতার অভাব
- বাজেট সংকট
- অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ
- তদারকির ঘাটতি
- আইনি প্রয়োগে দুর্বলতা
এই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে সরকার, মালিক, শ্রমিক ও ক্রেতা—সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
কেন OHS ব্যবসার জন্যও লাভজনক
অনেকেই মনে করেন OHS বাস্তবায়ন শুধু খরচ বাড়ায়, কিন্তু বাস্তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ।
✅ কম দুর্ঘটনা মানে কম ক্ষতি
✅ কর্মীদের আস্থা বৃদ্ধি
✅ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
✅ ক্রেতার আস্থা অর্জন
✅ প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধি
উপসংহার
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মৌলিক মানবাধিকার।
একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ কর্মীর মনোবল বাড়ায়, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা উন্নত করে এবং সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে যদি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান Occupational Health and Safety (OHS) নীতিমালা বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়, তাহলে শুধু কর্মীদের জীবন নয়—দেশের শিল্পখাতের ভবিষ্যৎও আরও টেকসই হয়ে উঠবে।
FAQ
প্রশ্ন ১: OHS নীতিমালা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক কি?
উত্তর: হ্যাঁ, বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে প্রতিটি নিয়োগকর্তার জন্য কর্মক্ষেত্র নিরাপদ রাখা বাধ্যতামূলক।
প্রশ্ন ২: OHS বাস্তবায়নে HR-এর ভূমিকা কী?
উত্তর: প্রশিক্ষণ, সচেতনতা, নীতিমালা প্রণয়ন ও কর্মক্ষেত্র তদারকির মাধ্যমে HR OHS নিশ্চিত করে।
প্রশ্ন ৩: PPE ব্যবহার কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: PPE কর্মীদের জীবন রক্ষা করে, কারণ এটি দুর্ঘটনা ও আঘাতের ঝুঁকি কমায়।
প্রশ্ন ৪: বাংলাদেশের কোন আইন OHS বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে?
উত্তর: বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) এবং BNBC (বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড)।
প্রশ্ন ৫: OHS বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
উত্তর: সচেতনতার অভাব এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি।