শ্রম আইন ২০০৬ ধারা ২০: ছাঁটাই (Retrenchment) ও এর নিয়মাবলি বিস্তারিত

শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২০: ছাঁটাই (Retrenchment) কী এবং এর নিয়মাবলি কী?

বাংলাদেশের শ্রম আইনে “ছাঁটাই” বা Retrenchment একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট কারণে একজন বা একাধিক শ্রমিককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারে।
তবে এই ছাঁটাই ইচ্ছেমতো করা যায় না। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) এর ধারা ২০ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, কীভাবে, কখন এবং কোন শর্তে ছাঁটাই বৈধ হবে।

এই লেখায় আমরা সহজ ভাষায় জানবো—
ছাঁটাই কী, কেন হয়, ধারা ২০ অনুযায়ী ছাঁটাইয়ের নিয়মাবলি কী, এবং ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার ও মালিকের দায়িত্ব কী।

 শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২০: ছাঁটাই (Retrenchment) কী এবং এর নিয়মাবলি কী?


ছাঁটাই (Retrenchment) কী?

ছাঁটাই” শব্দটি অনেক সময় “চাকরিচ্যুতি” বা “termination” এর সঙ্গে মিশে যায়, কিন্তু দুটি বিষয় এক নয়।
ছাঁটাই (Retrenchment) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো শ্রমিকের আচরণ বা অপরাধের কারণে নয়, বরং অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক বা কাজের অভাবে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

অর্থাৎ, যখন কোনো প্রতিষ্ঠান তার উৎপাদন কমায়, খরচ কমানোর জন্য জনবল হ্রাস করে, অথবা কাজের চাপ কমে যায়—তখন তারা কিছু শ্রমিককে ছাঁটাই করতে পারে।


ধারা ২০ অনুযায়ী ছাঁটাইয়ের আইনি ভিত্তি

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২০ অনুসারে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এক বা একাধিক শ্রমিককে ছাঁটাই করতে চায়, তবে তা অবশ্যই আইনানুগ প্রক্রিয়ায় করতে হবে।
অন্যথায়, ছাঁটাই অবৈধ গণ্য হবে এবং শ্রমিক আদালতে প্রতিকার চাইতে পারবেন।


ছাঁটাইয়ের কারণসমূহ (Grounds of Retrenchment)

নিচের কারণগুলো সাধারণত ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য:

  • অর্থনৈতিক সংকট বা লোকসান – প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে দুর্বল হলে।
  • কাজের ঘাটতি (Lack of Work) – উৎপাদন কমে গেলে বা চাহিদা হ্রাস পেলে।
  • প্রযুক্তিগত পরিবর্তন – স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি বা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের প্রয়োজন কমে গেলে।
  • ব্যবস্থাপনার পুনর্গঠন (Restructuring) – প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে সংগঠিত হলে বা শাখা বন্ধ করলে।

ধারা ২০ অনুযায়ী ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া (Procedure of Retrenchment)

আইন অনুযায়ী, কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই করার আগে কিছু নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হলো:


১. ১২০ দিনের ধারাবাহিক চাকরির শর্ত

শ্রমিককে ছাঁটাই করার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে তিনি কমপক্ষে ১২০ দিন ধারাবাহিকভাবে চাকরি করেছেন।
যদি ১২০ দিনের কম সময় চাকরি করেন, তাহলে তাঁকে ছাঁটাই করা যাবে না; বরং তাঁর চাকরি “termination” বা “discharge” হিসেবে বিবেচিত হবে।


২. ১ মাসের লিখিত নোটিশ প্রদান

প্রতিষ্ঠান শ্রমিককে কমপক্ষে ১ মাসের পূর্বে লিখিত নোটিশ দিতে বাধ্য।
নোটিশে উল্লেখ করতে হবে:

  • ছাঁটাইয়ের কারণ
  • কার্যকর হওয়ার তারিখ
  • এবং বকেয়া পাওনা নিষ্পত্তির তথ্য

অথবা, প্রতিষ্ঠান চাইলে ১ মাসের নোটিশ না দিয়ে ১ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিককে দিতে পারে (payment in lieu of notice)।


৩. ‘লাস্ট কাম, ফার্স্ট গো’ নীতি (Last Come, First Go Rule)

যখন একাধিক শ্রমিককে ছাঁটাই করতে হয়, তখন আইন অনুযায়ী শেষে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিককে আগে ছাঁটাই করতে হবে।
এটি ন্যায্যতার একটি মূলনীতি, যাতে সিনিয়র কর্মীদের অগ্রাধিকার থাকে।

তবে, যদি কোনো নির্দিষ্ট কর্মী প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অপরিহার্য হন, তাহলে এই নীতি কিছুটা শিথিল করা যেতে পারে—কিন্তু তা যৌক্তিক হতে হবে।


৪. শ্রমিক ইউনিয়ন বা প্রতিনিধিকে অবহিত করা

যদি প্রতিষ্ঠানে কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন (Trade Union) থাকে, তবে ছাঁটাইয়ের আগে ইউনিয়নকেও লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে।
এটি স্বচ্ছতা ও শ্রমিকের অধিকার রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।


৫. ছাঁটাই ক্ষতিপূরণ (Compensation)

প্রতিটি ছাঁটাই শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী।

ধারা ২০ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের হার:প্রতি

উদাহরণ:
যদি কেউ ১০ বছর চাকরি করেন এবং মাসিক বেতন ১৫,০০০ টাকা হয়,
তাহলে ক্ষতিপূরণ হবে:
১৫,০০০ × ১০ = ১,৫০,০০০ টাকা।


৬. ছাঁটাই নোটিশের অনুলিপি শ্রম পরিদর্শককে পাঠানো

নোটিশের একটি কপি স্থানীয় শ্রম পরিদর্শক (Labour Inspector) এর কাছে জমা দিতে হয়।
এটি আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক ধাপ।


৭. পুনর্নিয়োগে অগ্রাধিকার (Re-employment Priority)

ধারা ২১ অনুযায়ী, যদি ছাঁটাইয়ের পর ১ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠান নতুন শ্রমিক নিয়োগ করে,
তাহলে পূর্বে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।


ছাঁটাই ও চাকরিচ্যুতি (Termination) এর পার্থক্য

বিষয় ছাঁটাই (Retrenchment) চাকরিচ্যুতি (Termination)
কারণ অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, কাজের ঘাটতি শৃঙ্খলাভঙ্গ, অসদাচরণ বা কর্মদক্ষতার অভাব
নোটিশ ১ মাসের নোটিশ বা নোটিশের বদলে অর্থ ১ মাসের নোটিশ
ক্ষতিপূরণ প্রতি বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ প্রযোজ্য নয়
তদন্ত প্রয়োজন? না হ্যাঁ, যদি অসদাচরণের অভিযোগ থাকে

ছাঁটাইয়ের পর শ্রমিকের অধিকার

  • বকেয়া মজুরি ও ওভারটাইম পাওনা নিষ্পত্তি।
  • ছাঁটাই ক্ষতিপূরণ আইন অনুযায়ী প্রদান।
  • নোটিশ পিরিয়ডের অর্থ (যদি নোটিশ না দেওয়া হয়)।
  • নিয়োগে অগ্রাধিকার অধিকার (Re-employment)।
  • শ্রম আদালতে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ।

মালিকের দায়িত্ব

একজন মালিক বা নিয়োগকর্তা শ্রম আইন মেনে চলতে বাধ্য। ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ব হলো—

  • সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা,
  • লিখিত নোটিশ প্রদান,
  • ক্ষতিপূরণ যথাসময়ে পরিশোধ করা,
  • এবং প্রমাণসহ ছাঁটাইয়ের রেকর্ড সংরক্ষণ করা।

অন্যথায়, শ্রমিক আদালতে মামলা হলে আদালত ছাঁটাই অবৈধ ঘোষণা করতে পারে।


ছাঁটাইয়ের সময় যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে

  • প্রমাণ বা যুক্তি ছাড়া ছাঁটাই নয়।নোটিশে ছাঁটাইয়ের কারণ পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
  • নোটিশের একটি কপি শ্রম পরিদর্শক ও ইউনিয়নকে দিতে হবে।
  • ছাঁটাইয়ের তারিখে সব পাওনা নিষ্পত্তি করতে হবে।

অবৈধ ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিকার

যদি কোনো শ্রমিক মনে করেন যে তাঁকে অন্যায়ভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে,
তাহলে তিনি শ্রম আদালতে (Labour Court) মামলা করতে পারেন।

আদালত যদি দেখে যে ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়ায় আইন লঙ্ঘন হয়েছে, তাহলে—

  • ছাঁটাই বাতিল করে শ্রমিককে পুনর্বহাল করতে পারে,
  • অথবা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দিতে পারে।

ধারা ২০ এর বাস্তব প্রয়োগ

একটি গার্মেন্টস কারখানা লোকসানের কারণে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ৫০ জন শ্রমিকের কাজ আর নেই।
এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান চাইলে ধারা ২০ অনুযায়ী বৈধভাবে ছাঁটাই করতে পারে—
তবে শর্ত হলো, নোটিশ প্রদান, ক্ষতিপূরণ পরিশোধ, এবং শ্রম পরিদর্শককে অবহিত করা।

যদি তারা এই ধাপগুলো না মেনে সরাসরি শ্রমিকদের বিদায় করে দেয়,
তাহলে সেটি অবৈধ ছাঁটাই (Illegal Retrenchment) হিসেবে গণ্য হবে।


ছাঁটাইয়ের পরিবর্তে বিকল্প সমাধান

অনেক সময় ছাঁটাই না করে প্রতিষ্ঠান বিকল্প উপায় নিতে পারে, যেমন:

  • কর্মঘণ্টা সাময়িকভাবে কমানো
  • অস্থায়ী ছুটি (Lay-off) প্রদান
  • কাজের স্থানান্তর বা পুনর্বিন্যাস
  • এতে শ্রমিকও বেকার হয় না, আর প্রতিষ্ঠানও স্থিতিশীল থাকে।

FAQ (সাধারণ জিজ্ঞাসা)

১. ছাঁটাই ও লে-অফ (Lay-off) কি একই জিনিস?
না। লে-অফ হলো সাময়িক কর্মবিরতি, আর ছাঁটাই স্থায়ী অব্যাহতি।

২. ছাঁটাইয়ের সময় নোটিশ না দিলে কী হবে?
নোটিশ না দিলে ১ মাসের বেতনের সমান অর্থ দিতে হবে।

৩. ৬ মাস চাকরি করার পর কি ছাঁটাই ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে?
না, ধারা ২০ অনুযায়ী কমপক্ষে ১২০ দিন ধারাবাহিক চাকরি করতে হবে, তবে ক্ষতিপূরণ সাধারণত ১ বছরের চাকরির পর হিসাব করা হয়।

৪. ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় কি?
হ্যাঁ, শ্রম আদালতে মামলা করে প্রতিকার চাওয়া যায়।

৫. পুনর্নিয়োগে অগ্রাধিকার কতদিন পর্যন্ত থাকে?
ছাঁটাইয়ের তারিখ থেকে ১ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠান নতুন নিয়োগ দিলে, পূর্বের শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দিতে হয়।


উপসংহার

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২০ শ্রমিক ও মালিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে।
এটি যেমন প্রতিষ্ঠানকে অর্থনৈতিক সংকটে টিকে থাকতে সাহায্য করে,
তেমনি শ্রমিককেও বৈধ ক্ষতিপূরণ ও ন্যায্যতার অধিকার নিশ্চিত করে।

সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে “ছাঁটাই” কখনো অন্যায় নয়—
বরং এটি একটি ন্যায্য প্রক্রিয়া, যেখানে উভয় পক্ষের অধিকার ও মর্যাদা বজায় থাকে।


নবীনতর পূর্বতন