(গার্মেন্টস শিল্পে কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সেরা চর্চা)
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা হলো Ready-Made Garments (RMG) Sector। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০% আসে এই খাত থেকে, যেখানে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক।
তবে এই বিশাল অবদান সত্ত্বেও কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা (Occupational Health & Safety) নিয়ে প্রশ্ন এখনও থেকেই যায়।
Occupational Health and Safety (OHS) মানে হলো কর্মক্ষেত্রে এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে শ্রমিকরা দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা মানসিক চাপের ভয় ছাড়াই কাজ করতে পারে।
RMG সেক্টরে OHS কেবল আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একটি নৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন। নিরাপদ কর্মপরিবেশ মানে উৎপাদনশীলতা, মান ও কর্মীর আস্থা বৃদ্ধি।
এই আর্টিকেলে আমরা জানব—বাংলাদেশের RMG খাতে OHS বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো কী, কেন এটি এত জরুরি, এবং কীভাবে কার্যকর সমাধান তৈরি করা সম্ভব।
Occupational Health & Safety (OHS) কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ
OHS হলো এমন একটি ব্যবস্থাপনা কাঠামো যা কর্মক্ষেত্রে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ঝুঁকি হ্রাস করে এবং কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ—
- শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী, যারা দীর্ঘ সময় ধরে গরম, ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন।
- মেশিন, আগুন, রাসায়নিক পদার্থ এবং অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেশি।
- আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন OHS Compliance কে মূল মানদণ্ড হিসেবে দেখে।
তাই, OHS মেনে চলা কেবল শ্রমিকদের নিরাপত্তা নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও ব্যবসার টেকসই বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
RMG Sector-এ OHS সম্পর্কিত বাস্তব চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে গার্মেন্টস খাতে OHS বাস্তবায়নের পথে বেশ কিছু বাস্তব সমস্যা রয়ে গেছে। নিচে সেগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলোঃ
১. সচেতনতার অভাব
অনেক শ্রমিকই এখনো জানে না তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত অধিকার কী।
প্রায়ই PPE (Personal Protective Equipment) সরবরাহ করা হলেও তারা তা ব্যবহার করে না।
এর পেছনে কারণ হলো—প্রশিক্ষণের অভাব ও ভুল ধারণা যে PPE পরলে কাজ ধীরগতিতে হয়।
২. অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সব ফ্যাক্টরিতে সঠিক Emergency Exit, Fire Alarm, বা Smoke Detector নেই।
অগ্নিকাণ্ডের সময় দরজা বন্ধ থাকা, সংকীর্ণ সিঁড়ি বা সঠিক আগুন নেভানোর সরঞ্জাম না থাকাই বড় বিপদ ডেকে আনে।
Tazreen Fashions (2012) এবং Rana Plaza (2013) দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা অবহেলার ভয়াবহ পরিণতি।
৩. স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও অতিরিক্ত কাজের চাপ
দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করার কারণে অনেক শ্রমিকের পিঠে ও মাংসপেশিতে ব্যথা হয়।
বদ্ধ ও গরম পরিবেশে Heat Stress, শ্বাসকষ্ট, এবং চর্মরোগও দেখা যায়।
পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ও বিশ্রামের অভাব এই সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তোলে।
৪. মানসিক চাপ ও হয়রানি
OHS শুধু শারীরিক নয়, মানসিক নিরাপত্তাও অন্তর্ভুক্ত করে।
তবে অনেক ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকরা অতিরিক্ত কাজের চাপ, শব্দদূষণ, অপমানজনক আচরণ, বা বুলিং-এর মুখোমুখি হয়।
ফলে তাদের উৎপাদনশীলতা ও আত্মবিশ্বাস উভয়ই কমে যায়।
৫. আইন প্রয়োগের দুর্বলতা
যদিও বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র নিরাপদ রাখা বাধ্যতামূলক, কিন্তু বাস্তবে তা প্রয়োগে ঘাটতি রয়ে গেছে।
তদারকির অভাব, দুর্বল মনিটরিং এবং কিছু মালিকের উদাসীন মনোভাব বিষয়টিকে আরও কঠিন করে তোলে।
RMG খাতে OHS উন্নয়নের জন্য কার্যকর সমাধান
চ্যালেঞ্জ থাকলেও সমাধান অসম্ভব নয়। নিচে কয়েকটি বাস্তবসম্মত উপায় উল্লেখ করা হলো যা প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রহণ করতে পারে—
১. সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
নিরাপত্তা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করা জরুরি।
- Fire Drill অন্তত প্রতি ৩ মাসে একবার করা উচিত।
- কর্মীদের শেখানো উচিত PPE-এর সঠিক ব্যবহার, আগুন লাগলে কীভাবে বের হতে হবে, এবং দুর্ঘটনা ঘটলে কাকে জানাতে হবে।
প্রশিক্ষণ শুধু শ্রমিক নয়, Supervisor ও Management Level-এর জন্যও প্রয়োজন।
২. PPE সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা
প্রতিটি কর্মীর জন্য উপযুক্ত Safety Helmet, Gloves, Ear Plug, Mask, Safety Shoe থাকা বাধ্যতামূলক।
PPE-এর গুণমানও গুরুত্বপূর্ণ—নকল বা নিম্নমানের সরঞ্জাম জীবন বাঁচাতে পারে না।
HR বিভাগকে নিয়মিত পরিদর্শন করে নিশ্চিত করতে হবে যে শ্রমিকরা PPE সঠিকভাবে ব্যবহার করছে।
৩. স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়ন
- প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে First Aid Box, Medical Room এবং প্রশিক্ষিত Paramedic Staff থাকা উচিত।
- নিয়মিত Health Check-up এবং Vaccination Program পরিচালনা করতে হবে।
- তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে শ্রমিকরা স্বস্তিতে কাজ করতে পারে।
৪. মানসিক সুস্থতা ও সহনশীল কর্মসংস্কৃতি গঠন
একটি স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশে মানসিক নিরাপত্তা অপরিহার্য।
ম্যানেজমেন্টকে এমন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যেখানে—
- শ্রমিকরা ভয় ছাড়া অভিযোগ জানাতে পারে।
- হয়রানি বা অপমানজনক আচরণের কোনো স্থান থাকবে না।
- পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার পরিবেশ থাকবে।
৫. অগ্নি নিরাপত্তা (Fire Safety) শক্তিশালী করা
RMG ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তাই—
- Fire Extinguisher, Fire Alarm, Smoke Detector বাধ্যতামূলক করতে হবে।
- জরুরি নির্গমন পথ (Emergency Exit) সবসময় খোলা রাখতে হবে।
- নিয়মিত Fire Drill ও Evacuation Training পরিচালনা করতে হবে।
৬. আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ
OHS নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রম আইন ছাড়াও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড যেমন—
- ILO Convention 155
- ISO 45001 (Occupational Health & Safety Management System)
- Accord & Alliance-এর নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি।
এই মানগুলো অনুসরণ করলে শুধু কর্মীদের সুরক্ষা নয়, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থাও বৃদ্ধি পায়।
৭. প্রযুক্তি ব্যবহার ও মনিটরিং
নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন—
- Digital Attendance & Safety Monitoring System
- CCTV Surveillance
- IoT-based Fire Detection
এই টুলগুলো কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
RMG সেক্টরে OHS বাস্তবায়নে HR ও ম্যানেজমেন্টের ভূমিকা
HR বিভাগ OHS বাস্তবায়নের অন্যতম চালিকা শক্তি। তাদের দায়িত্ব হলো—
কর্মীদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ আয়োজন করা,
- দুর্ঘটনা রিপোর্ট ও বিশ্লেষণ করা,
- নিয়মিত নিরাপত্তা নিরীক্ষা (Safety Audit) করা,
- এবং শ্রমিকদের সঙ্গে উন্মুক্ত যোগাযোগ বজায় রাখা।
একই সঙ্গে, টপ ম্যানেজমেন্টের কমিটমেন্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারা বাজেট অনুমোদন করে, নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং দায়িত্ব বণ্টন করে।
OHS বাস্তবায়নের সুফল
✅ শ্রমিকদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি
✅ দুর্ঘটনা ও অনুপস্থিতি হ্রাস
✅ উৎপাদনশীলতা ও পণ্যের মান উন্নয়ন
✅ ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধি
✅ প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসইতা
উপসংহার
বাংলাদেশের RMG খাতে Occupational Health & Safety কেবল একটি নীতি নয়, বরং এটি মানবিক দায়িত্ব ও ব্যবসার অপরিহার্য অংশ।
যখন কর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে পারে, তখন তারা আরও মনোযোগী, উৎপাদনশীল এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে।
OHS বাস্তবায়নে সরকার, মালিক, শ্রমিক, ক্রেতা—সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগই হতে পারে এই খাতের টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি।
FAQ
প্রশ্ন ১: গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে OHS কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: কারণ এটি শ্রমিকদের জীবন রক্ষা করে, দুর্ঘটনা কমায় এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।
প্রশ্ন ২: PPE ব্যবহার বাধ্যতামূলক কি?
উত্তর: হ্যাঁ, শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে PPE সরবরাহ ও ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
প্রশ্ন ৩: OHS বাস্তবায়নের জন্য কী ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন?
উত্তর: Fire Safety, PPE Use, Chemical Handling, এবং Emergency Evacuation প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।
প্রশ্ন ৪: RMG সেক্টরে OHS বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
উত্তর: সচেতনতার অভাব, বাজেট সংকট, এবং তদারকির ঘাটতি।
প্রশ্ন ৫: OHS মানলে প্রতিষ্ঠানের কী লাভ হয়?
উত্তর: দুর্ঘটনা কমে, কর্মীরা সন্তুষ্ট থাকে, উৎপাদন বাড়ে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতার আস্থা অর্জিত হয়।