বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা | HR গাইড

🟩 বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা: কী কী জানতে হবে HR টিমকে

একজন কর্মজীবী নারীর জন্য মাতৃত্ব শুধু আনন্দ নয়, এটি একটি শারীরিক ও মানসিক দায়িত্বও। তাই বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ নারীদের “প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা” (Maternity Benefit) পাওয়ার অধিকারকে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই আইন শুধু মা হিসেবে তার মর্যাদাই রক্ষা করে না, বরং কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

এই লেখায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো —
👉 শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা কী,
👉 কে এই সুবিধা পাবেন,
👉 HR টিম ও নিয়োগকর্তার করণীয় কী,
👉 এবং বাস্তবে এই সুবিধা নিশ্চিত করার উপায়।

 বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা


প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা কী?

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (ধারা 45–50 অনুযায়ী) “প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা” হলো নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন সময়ের আর্থিক ও কর্মসংস্থান সংক্রান্ত অধিকার।
অর্থাৎ, কোনো নারী শ্রমিক গর্ভবতী হলে, তার জন্য নির্ধারিত ছুটি, মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে।

এই সুবিধার মূল উদ্দেশ্য হলো—

  • কর্মরত মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষা,
  • নবজাতকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা,
  • ও মাতৃত্বকালীন সময়ে আর্থিক নিরাপত্তা বজায় রাখা।

কে এই সুবিধা পাওয়ার যোগ্য?

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী,
একজন নারী শ্রমিক তখনই প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী, যদি তিনি—

  1. অন্তত ৬ মাস (অর্থাৎ ১৮০ দিন) ধারাবাহিকভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকেন।
  2. যদি কোনো নারীর দুই বা তার বেশি সন্তান আগেই জীবিত থাকে, তাহলে তিনি মাতৃত্বকালীন ভাতা পাবেন না, তবে তিনি চাইলে আইন অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে পারবেন।

এর মানে, নতুনভাবে চাকরিতে যোগ দিয়ে কয়েক মাস পর গর্ভবতী হলে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে এই সুবিধার আওতায় আসবেন না।
তবে ছয় মাস পূর্ণ হলে তিনি আইনগতভাবে এ সুবিধা দাবি করতে পারবেন।


প্রসূতি ছুটির সময়কাল ও নিয়মাবলি

🔹 মোট ছুটি:
শ্রম আইন অনুযায়ী, একজন নারী শ্রমিক সর্বমোট ১৬ সপ্তাহ (৪ মাস) প্রসূতি ছুটি পাবেন —

  • ৮ সপ্তাহ প্রসবের আগে, এবং
  • ৮ সপ্তাহ প্রসবের পরে।

এই সময়কালে নিয়োগকর্তা কোনোভাবেই তাকে কাজ করতে বাধ্য করতে পারবেন না।

যদিও বর্তমানে উক্ত ছুটি ১২০দিন ধার্য্য করা হয়েছে। 

🔹 ছুটির সময়ে বেতন:
প্রসূতি ছুটির সময় শ্রমিক তার সম্পূর্ণ মজুরি (Full Wages) পাওয়ার অধিকার রাখেন।
এই অর্থ সাধারণত মাসিক বেতন অনুযায়ী, ছুটির পুরো সময়ের জন্য একত্রে বা দুই কিস্তিতে প্রদান করা হয়।

প্রসূতি কল্যাণ সুবিধার হিসাব (Maternity Benefit Calculation)

# পূর্ববর্তী মাসের প্রাপ্ত বেতন/২৬*১২০ দিন

স্যাম্পল:

  

🔹 অবৈধ ছাঁটাই নিষিদ্ধ:
প্রসূতি অবস্থায় বা ছুটি চলাকালীন সময়ে কোনো নারী শ্রমিককে ছাঁটাই বা বরখাস্ত করা যাবে না।
এটি করলে তা শ্রম আইন অনুযায়ী অবৈধ কর্ম হিসেবে গণ্য হবে এবং নিয়োগকর্তাকে আইনগতভাবে দায়ী করা যেতে পারে।


প্রসূতি সুবিধা প্রদানের প্রক্রিয়া (HR ও নিয়োগকর্তার করণীয়)

একটি HR টিমের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— আইন মেনে সুবিধাটি বাস্তবায়ন করা। নিচে ধাপে ধাপে প্রক্রিয়াটি উল্লেখ করা হলোঃ

১. গর্ভধারণের নোটিফিকেশন গ্রহণ

নারী শ্রমিক গর্ভবতী হলে, তিনি HR বিভাগে লিখিতভাবে জানাবেন।
HR বিভাগকে বিষয়টি গোপনীয়ভাবে ডকুমেন্টেশন করতে হবে।

২. যোগ্যতা যাচাই

HR টিম যাচাই করবে, শ্রমিকটি অন্তত ৬ মাসের চাকরির মেয়াদ পূর্ণ করেছেন কি না।
যদি পূর্ণ করেন, তবে তিনি সুবিধার জন্য উপযুক্ত।

৩. ছুটি অনুমোদন ও বেতন নির্ধারণ

প্রসূতি ছুটির জন্য HR ম্যানেজমেন্টকে আবেদনটি প্রক্রিয়াজাত করে অনুমোদন দিতে হবে এবং তার সম্পূর্ণ বেতন নিশ্চিত করতে হবে।

৪. রেকর্ড সংরক্ষণ

সব প্রসূতি ছুটির তথ্য প্রতিষ্ঠানটির Attendance, Payroll এবং Personal File-এ সংরক্ষণ করতে হবে।
এটি শ্রম পরিদর্শন বা অডিটের সময় গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।

৫. কর্মস্থলে ফিরে আসার পর সহায়তা

প্রসূতি ছুটি শেষে ফিরে আসা নারী কর্মীকে তার আগের দায়িত্ব বা সমতুল্য কাজ দিতে হবে।
তাকে কোনোরূপ বৈষম্য বা পদাবনতি করা যাবে না।


প্রসূতি কল্যাণ তহবিল ও সরকারি সহযোগিতা

বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন শিল্পখাতে “প্রসূতি কল্যাণ তহবিল” (Maternity Benefit Fund) গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে।
বিশেষ করে RMG সেক্টর, ইপিজেড (EPZ) এবং ফ্যাক্টরি লেভেলে, শ্রমিকদের এই সুবিধা নিশ্চিত করতে HR ও প্রশাসনের সহযোগিতা অপরিহার্য।

এই তহবিলের অর্থ শ্রমিকের কল্যাণে ব্যয় করা হয়, যেমনঃ

  • মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা
  • নবজাতকের টিকাদান ও পুষ্টি
  • ও প্রসূতি ছুটিকালীন আর্থিক সহায়তা

আইন লঙ্ঘনের শাস্তি

যদি কোনো নিয়োগকর্তা—

  • গর্ভবতী শ্রমিককে অবৈধভাবে ছাঁটাই করেন,
  • বা প্রসূতি ছুটি ও সুবিধা প্রদান না করেন,

তাহলে শ্রম আইন ২০০৬ (ধারা 50) অনুযায়ী তিনি জরিমানা বা অন্যান্য আইনগত শাস্তির আওতায় আসতে পারেন।

শ্রম আদালতে অভিযোগ দায়ের করলে, শ্রমিক তার বকেয়া বেতন ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রাখেন।


প্রসুতি কল্যাণ সুবিধা (Maternity Benefit) সংক্রান্ত কিছু ভুল বোঝাবোঝির অবসান 

HR টিমের জন্য ৫টি গুরুত্বপূর্ণ টিপস

  • গর্ভবতী শ্রমিকের তথ্য গোপনীয় রাখুন।
  • মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং বেতন নীতিমালা স্পষ্টভাবে Policy Handbook-এ উল্লেখ করুন।
  • Attendance Software-এ ছুটির ধরন হিসেবে “Maternity Leave” অন্তর্ভুক্ত করুন।
  • ছুটিকালীন সময়ে যোগাযোগ ও সহযোগিতার মনোভাব বজায় রাখুন।
  • আইন অনুযায়ী নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিন—বিশেষ করে Line Manager ও Supervisor-দের।

প্রসূতি কল্যাণ সুবিধার সামাজিক গুরুত্ব

এই সুবিধা শুধুমাত্র শ্রমিকের অধিকার নয়, বরং একটি কর্মক্ষেত্রের মানবিকতা ও সুশাসনের প্রতীক।
যে প্রতিষ্ঠান নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সময়কে গুরুত্ব দেয়, সেখানে কর্মী ধরে রাখার হার বেশি থাকে এবং উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পায়।


প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)

প্রশ্ন ১: প্রসূতি ছুটি কতদিন?
উত্তর: মোট ১৬ সপ্তাহ — ৮ সপ্তাহ আগে এবং ৮ সপ্তাহ পরে।

প্রশ্ন ২: প্রসূতি ছুটির সময়ে কি বেতন পাবেন?
উত্তর: হ্যাঁ, সম্পূর্ণ মজুরি (Full Salary) প্রদান করতে হবে।

প্রশ্ন ৩: চাকরিতে ৬ মাস পূর্ণ না হলে কি এই সুবিধা পাওয়া যাবে?
উত্তর: না, অন্তত ৬ মাস ধারাবাহিক চাকরি থাকতে হবে।

প্রশ্ন ৪: ছুটি শেষে কাজে ফিরলে আগের পদে ফেরত আসা যাবে কি?
উত্তর: অবশ্যই, নিয়োগকর্তা সমতুল্য কাজ দিতে বাধ্য।

প্রশ্ন ৫: আইন লঙ্ঘন করলে কী হবে?
উত্তর: নিয়োগকর্তা শ্রম আদালতের আওতায় পড়বেন এবং জরিমানার শাস্তি হতে পারে।


উপসংহার

প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা শুধুমাত্র আইনগত বিষয় নয়, এটি মানবিক দায়িত্বও।
একজন মা যেমন তার পরিবারের ভিত্তি, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও তিনি এক অপরিহার্য শক্তি।
তাই HR পেশাজীবীদের উচিত এই সুবিধাগুলো শুধু আইন মেনে নয়, বরং সহমর্মিতার জায়গা থেকে নিশ্চিত করা।

একটি প্রতিষ্ঠান তখনই “স্মার্ট ও মানবিক” যখন তারা মায়ের অধিকারকে সম্মান করে এবং কর্মস্থলকে নিরাপদ রাখে।


# বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬, # প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা, # মাতৃত্বকালীন ছুটি, # HR টিমের করণীয়, # শ্রমিক অধিকার, # Maternity Benefit Bangladesh, # শ্রম আইন ধারা 45-50

নবীনতর পূর্বতন